রজব মাসের তাৎপর্য, ফযিলত ও করণীয় বিষয়ে হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ উলামা কাউন্সিলের সভাপতি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী সাহেব— যার সারসংক্ষেপ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:
রজব— হারাম মাস ও আত্মসংযমের সময়
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী বলেন, “রজব এমন একটি মাস, যার মর্যাদা আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং কুরআনে ঘোষণা করেছেন। এটি চারটি হারাম মাসের অন্যতম, যেখানে পাপাচার ও জুলুম থেকে বিরত থাকার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।”
তিনি কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন—
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ… مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো… এর মধ্যে চারটি সম্মানিত (হারাম) মাস। সুতরাং এসব মাসে তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম করো না।” [সূরা আত-তাওবা: ৩৬]
তিনি বলেন, “এই আয়াত রজব মাসকে আত্মসংযম, তাকওয়া ও নৈতিক শুদ্ধতার মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।”
‘রজব আল্লাহর মাস’
রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর একটি প্রসিদ্ধ ফযিলতসংক্রান্ত হাদিস উল্লেখ করে তিনি বলেন—
رَجَبُ شَهْرُ اللَّهِ، وَشَعْبَانُ شَهْرِي، وَرَمَضَانُ شَهْرُ أُمَّتِي
“রজব আল্লাহর মাস, শা‘বান আমার মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস।” [কানযুল উম্মাল, হাদিস ৩৫১২৭]
আলেম-উলামাদের মতে, হাদিসটি সনদের দিক থেকে ফাযায়েলুল আমাল (ফযিলত বর্ণনা) হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
আহলে বাইত (আ.)–এর বর্ণনায় রজব মাস
মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী বলেন, “আহলে বাইত (আ.)–এর হাদিসে রজব মাসকে আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণকাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।”
তিনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.)–এর হাদিস উদ্ধৃত করেন—
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ نَهْرًا يُقَالُ لَهُ رَجَبٌ، أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ، وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ…
“নিশ্চয়ই জান্নাতে একটি নদী রয়েছে যার নাম ‘রজব’; যা দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৪, পৃষ্ঠা ৬৫]
১লা রজব—ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকির (আ.)–এর বেলাদাত
রজব মাসের সূচনালগ্নের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “১লা রজব হলো পঞ্চম ইমাম, হযরত মুহাম্মদ আল-বাকির (আ.)–এর শুভ জন্মদিন।”
তিনি বলেন, “ইমাম বাকির (আ.) ‘বাকিরুল উলুম’—অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বার উন্মোচনকারী হিসেবে পরিচিত। ইসলামী ফিকহ, তাফসির ও আকিদাগত জ্ঞানের বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর বেলাদাত দিয়ে রজব মাসের সূচনা হওয়া এই মাসের জ্ঞান ও আত্মিক তাৎপর্যকে আরও গভীর করে।”
তওবা- ইস্তিগফার ও দোয়ার মাস
মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী বলেন, “রজব মাস মূলত তওবা, দোয়া ও আত্মশুদ্ধির মাস।”
তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর হাদিস উল্লেখ করেন—
أَكْثِرُوا فِي رَجَبٍ مِنَ الِاسْتِغْفَارِ، فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“রজব মাসে তোমরা বেশি বেশি ইস্তিগফার করো, কারণ আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৫]
তিনি বিশেষভাবে— اَستَغفِرُاللهَ وَ اَسئَلُهُ التَوبَهَ তওবাটি বেশি বেশি (দিনে অন্তত ১০০ বার) পড়ার জন্য তাগিদ করেন। পাশাপাশি প্রতি নামাজ শেষে দোয়ায়ে রাজাভিয়া পড়ার গুরুত্ব আরোপ করেন, কেননা এটি আত্মশুদ্ধি, তওবা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য একটি ফযিলতপূর্ণ দোয়া।
রজব মাসে রোজা রাখার গুরুত্ব
মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী বলেন, “রজব মাসে নফল রোজা রাখা আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রোজা মানুষের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হৃদয়কে তাকওয়ার আলোয় আলোকিত করে।”
তিনি আহলে বাইত (আ.)–এর বর্ণিত একটি হাদিসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন—
مَنْ صَامَ يَوْمًا مِنْ رَجَبٍ اسْتَوْجَبَ رِضْوَانَ اللَّهِ
“যে ব্যক্তি রজব মাসে একদিন রোজা রাখে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অধিকারী হয়।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৪]
তিনি আরও বলেন, “ইমাম জাফর সাদিক (আ.)–এর বর্ণনায় এসেছে—রজব মাসে একটি রোজা জান্নাতের পথ সহজ করে দেয়। এ কারণে আহলে বাইত (আ.) তাঁদের অনুসারীদের এই মাসে সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক নফল রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।”
মাওলানা রাজাভী বলেন, “রজবের রোজা মূলত রমজানের জন্য আত্মিক প্রস্তুতি। যে ব্যক্তি এই মাসে রোজার অভ্যাস গড়ে তোলে, তার জন্য রমজানের ফরজ রোজা পালন সহজ হয়ে যায় এবং সে অধিক খুশু ও খুজুর সঙ্গে ইবাদত করতে সক্ষম হয়।”
ঐতিহাসিক মর্যাদা
তিনি বলেন, “১৩ রজব—কাবাঘরের ভেতরে আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আ.)–এর জন্ম এবং ২৭ রজব—রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর মেরাজ ও নবুয়ত প্রাপ্তি রজব মাসকে ইসলামের ইতিহাসে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।”
যুবসমাজ ও মুসলমানদের প্রতি আহবান
সাক্ষাৎকারের শেষাংশে তিনি বলেন, “রজব হলো রমজানের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ। যে ব্যক্তি রজবে নিজেকে সংশোধন করতে পারে, তার জন্য শা‘বান ও রমজান আত্মিক সফলতার মৌসুমে পরিণত হয়।”
তিনি মুসলমানদের বিশেষ করে যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন,
“রজব মাসকে যদি আত্মগঠন, নামাজ, কুরআন ও তওবার মাস হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তবে ব্যক্তি ও সমাজ— উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।”
পরিসামাপ্তি, রজব মাস কেবল একটি সময় নয়; এটি আত্মশুদ্ধি, জ্ঞানচর্চা, তওবা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক গভীর আত্মিক যাত্রা। কুরআন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং আহলে বাইত (আ.)–এর নির্দেশনার আলোকে এই মাসকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই একজন মুমিন রমজানের পূর্ণ বরকত লাভের উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
আপনার কমেন্ট